HSC

আঞ্চলিক পর্যায়ে সফল আত্মকর্মসংস্থানকারী ও সফল উদ্যোক্তার কাহিনী

ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ১ম পত্র - আঞ্চলিক পর্যায়ে সফল আত্মকর্মসংস্থানকারী ও সফল উদ্যোক্তার কাহিনী

বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ। যেখানেই উদ্যোগ নিয়ে কোনো কাজে কেউ এগিয়ে গেছে দু'চারটে ব্যতিক্রম বাদ দিলে সেখানেই সফলতা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে এখন তার চিরায়ত গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তাই ব্যাপক প্রচারিত না হলেও নিরবে রচিত হচ্ছে অনেক সাফল্য গাঁথা । এদের অনেকেই আত্মকর্মসংস্থানের জন্য কাজ শুরু করলেও এক পর্যায়ে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করছেন । এমনই দু'একজনের জীবন সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হলো :

চা শ্রমিক থেকে সফল কৃষক কুমার দুধবংশী

কৃষকের ছেলে ভালো কৃষক হবে নতুন ফসল ফলাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চা শ্রমিক- যাদের জীবন সাধারণ কৃষক ও পেশাজীবী মানুষ থেকে ভিন্নতর তারা যদি সামান্য সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থেকে কৃষি ক্ষেত্রে নেমে সফল কৃষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও সম্মান লাভ করতে পারে তবে তা নিঃসন্দেহে গৌরবের। এমনই একজন সফল কৃষক কুমার দুধবংশী।

চা শ্রমিক সম্পর্কে যারা কিছুটা খোঁজ-খবর রাখেন তারা জানেন তাদের জীবন কত কষ্টের । দৈনিক মাত্র ৪৮ টাকা মজুরি পেয়ে তা দিয়ে ১১ জন সদস্যের পরিবার চালিয়েছেন কুমার দুধবংশী। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার খাই ছড়া চা বাগানে আর পাঁচজন সাধারণ শ্রমিকের মত তারও জীবন ছিল ছকে বাধা। সকালে চা বাগান, চা পাতা সংগ্রহ, বাগান পরিচর্যার কাজ। আর সন্ধ্যা বেলায় পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধবের সাথে সুখ দুঃখের গল্প, হৈ-চৈ, আর সুযোগ পেলেই নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকা। কুমার দুধবংশীর মাথায় এলো সবাইতো এটা করছে । তাই ভিন্ন কিছু করা যায় কি না। চা বাগানের ভিতরে অনেক জমি এমনি পড়ে থাকে । সেখানে চাষবাস করে বাড়তি আয়ের চিন্তা নিয়েই তিনি প্রথমে কৃষিতে নেমে পড়েন। সব্জী চাষ দিয়ে শুরু হয় নতুন জীবন। তার বাগানে সারা বছর নানান ধরনের সব্জীর চাষ । বর্ষাকালে ঝিঙ্গা, করলা, বরবটি ইত্যাদির চাষ করেছেন। অন্য সময়ে বাধাকপি, টমেটো, আলু, লাউ ইত্যাদি চাষ হচ্ছে। বিক্রয় নিয়ে সমস্যা নেই। চা বাগানগুলোর হাজার হাজার শ্রমিক। তারাই তার ক্রেতা। তার কৃষি ক্ষেতে এক একটা পুষ্ট ঝিঙ্গার ওজন ৪০0 গ্রাম থেকে ৫৪০ গ্রাম । করলার ওজনও ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম। একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে তিন বছর কৃষি কাজ করার পর 'বিগত দু'বছরে তিনি স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেছেন। ২০১২ সালে রাজা টমেটোর চাষ করে তিনি এক লক্ষ টাকা আয় করেছেন। ঝিঙ্গা-করলা ইত্যাদি খাতেও লক্ষাধিক টাকা আয় হয়েছে । আলুর চাষ করে প্রায় ১০০ মণ আলু ফলিয়েছেন । এখন তার দেখাদেখি অনেকেই বাড়ির আশেপাশে ও পতিত জমিতে কৃষিকাজ করছে । তিনি এখন এলাকার একজন আদর্শ কৃষক ।

পোল্ট্রি খামার করে কোটিপতি হয়েছেন নিজাম

কঠোর পরিশ্রম, মেধা ও কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা থাকলে স্বল্প পুঁজি নিয়েও যে ভাগ্য বদল করা যায় তার বাস্তব প্রমাণ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জের পোল্ট্রি খামারি নিজাম । মাত্র ১২ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি পোল্ট্রি খামার করে বর্তমানে জেলার অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠিত পোল্ট্রি ব্যবসায়ী। তার পোল্ট্রি খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা ।

১৯৯৭ সালে স্থানীয় কলেজে বিএসএস (ডিগ্রি) শেষবর্ষের ছাত্র ছিলেন নিজাম। সংসারে ৪ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। মাথার ভেতর বড় ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন তার। শখের বসে বাড়ির পাশে একখণ্ড জমিতে গড়ে তোলেন পোল্ট্রি খামার। পুঁজি ১২ হাজার টাকা। পড়াশোনার পাশাপাশি খামারে ব্রয়লার মুরগির লালন-পালন চলে ভালোভাবে। নিজ এলাকার চন্দ্রগঞ্জ বাজারে একটি দোকান নিয়ে শুরু করেন ব্রয়লার মুরগির খুচরা বিক্রি। ১৯৯৮ সালে ঢাকার লায়ন এগ্রো অফিসে ৩ দিনব্যাপী পোল্ট্রি বিষয়ক কর্মশালায় অংশ নিয়ে মুরগি পালন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। এরপর তার আরো আগ্রহ বেড়ে যায়। ছেলের পরিশ্রম, আগ্রহ ও পোল্ট্রি খামারের ব্যবসার ভালো অবস্থা দেখে বাবা হোসেন আহমেদ পুঁজি দিলেন আরো ৭০ হাজার টাকা। সেই থেকে গতি পায় তার ব্যবসায় । খামার প্রসারে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেন তার ছোট ভাই শাহাবুদ্দিন ।

সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির পোল্ট্রি খাদ্য ও মেডিসিনের ডিলার নিয়ে তিনি গড়ে ! তোলেন সোনালি ফিডস অ্যান্ড চিকস। এ ছাড়া উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের জাউডগা গ্রামে ১০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে মমতাজ এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। এখানে রয়েছে লেয়ার মুরগি ও মৎস্য খামার। এ  খামারে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার ডিম উৎপাদন ও মৎস্য খামার থেকে বছরে ১০ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করা - হয় । এ ছাড়া তার আরো কয়েকটি মুরগির খামারে দৈনিক ৮ থেকে ৯ হাজার ডিম উৎপাদন হয় । ডিম বিক্রি হয় - দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এ লেয়ার খামারগুলো গড়ে তোলা হয়েছে সদর উপজেলার নূরুলাপুর, জকসিন, বসুরহাট, চন্দ্রগঞ্জের লতিফপুর ও বেগমগঞ্জ উপজেলার আমিনবাজারে ।

এ ছাড়া সদর উপজেলার ৫৫টি ব্রয়লার মুরগি খামারে তার বিনিয়োগ রয়েছে। এসব খামারের মালিককে সম্পূর্ণ বাকিতে বাচ্চা, খাদ্য ও মেডিসিন দেওয়া হয়। পরে বাচ্চা পরিপূর্ণ হলে তা বিক্রি করে খামার মালিকরা নিজামের বকেয়া পরিশোধ করেন। ব্রয়লার মুরগি ও লেয়ারের ডিম লক্ষ্মীপুর ও পার্শ্ববর্তী জেলা নোয়াখালী ও ফেনীতে সরবরাহ হয়ে থাকে। নিজামের প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ হওয়ায় প্রায় ৩৫টি পরিবারে আসে সচ্ছলতা । ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাসিক বেতন দেওয়া হচ্ছে আড়াই লাখ টাকা ।

মৎস্য চাষ করে স্বাবলম্বী রহিমা

সংগ্রামী মানুষের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। হতদরিদ্র রহিমা তাদেরই একজন। দিনমজুর বাবার বাড়ি ছিল পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার হাঁটুরিয়ার নাকালিয়ায় । রহিমা বাবার ঘরে থাকা অবস্থায় শেষ সম্বল ভিটাবাড়ি সর্বনাশা যমুনার করালগ্রাসে নিমজ্জিত হয় । অভাবী বাবা অপরিণত বয়সের রহিমাকে চাল-চুলাবিহীন রহিমের সঙ্গে বিয়ে দেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোলজুড়ে সন্তান আসে । দিশেহারা রহিম খাল-বিলে মাছ ধরে দিন যাপন করত। সেই সময়ও হাল ছাড়েননি রহিমা। স্বপ্ন দেখতেন একদিন একটি পুকুর লিজ নেবেন, সেখানে মাছ চাষ করে সন্তান লালন-পালন করবেন, সন্তানদের স্কুলে পড়াবেন, দু'বেলা পেট ভরে খাবেন । এ বিষয়গুলো গল্পের মতো মনে হলেও রহিমার কাছ থেকে শুনলে আরো বেশি মনে হয় ।

সরেজমিন জানা যায় পাবনার বেড়া উপজেলার চাকলা ইউনিয়নের রহিমা-রহিমের পরিবর্তনের কথা । রহিমা বলেন, ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আসিয়াব তাদের গ্রামে জরিপ চালায়। এ সময় হতদরিদ্র পরিবার হিসেবে তারা মনোনীত হয়। পরে ২৯ জন সদস্য নিয়ে জীবিকার সন্ধানে মহিলা উন্নয়ন সংগঠন নামে একটি দল গঠন করে আয়বর্ধনমূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন রহিমা । প্রশিক্ষণ শেষে অনুদান হিসেবে ১৪ হাজার টাকা ব্যবসায়ের জন্য এবং মাসিক জীবিকা সহায়ক ভাতা হিসেবে ২০ মাস ৫০০ টাকা হারে এবং দুর্যোগকালীন সহায়তা হিসেবে ৪ মাস ১ হাজার টাকা হারে মোট ২৮ হাজার টাকা পাবেন। রহিমা ব্যবসায়ের জন্য ১৪ হাজার টাকা পাওয়ার পর সেই টাকার সঙ্গে নিজের ছাগল ও হাঁস-মুরগি বিক্রয়ের টাকা মিলিয়ে মোট ২০ হাজার টাকা দিয়ে তিন বিঘার একটি পুকুর ১ বছরের জন্য লিজ নেন । সেই পুকুরে মাছের ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করেন। রহিমার কাছ থেকে জানা যায়, তিনি গত ৯ মাসে ৫৫ হাজার টাকার পোনামাছ ও মাছ বিক্রয় করেছেন । তার পুকুরের চারপাশে নেপিয়ার ঘাস ও লাউ বিক্রি করে অতিরিক্ত ১২ হাজার টাকা আয় করেন । আরো ৩টি পুকুর ৩০ হাজার টাকা দিয়ে লিজ নেন । যেখানে ৪০ হাজার টাকার পোনামাছ বড় করার জন্য চাষ করা হচ্ছে । রহিমার হিসাব মতে, বছর শেষে ৪টি পুকুর থেকে কমপক্ষে ২ লাখ টাকার মাছ বিক্রয় করবেন । উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এমন অসংখ্য রহিমা, যারা কি না আসিয়ারের হতদরিদ্রদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্পের সহযোগিতা পেয়ে নিজের জীবনে আমুল পরিবর্তন এনেছেন ।

 

Content added By
Promotion